নির্বাচনী সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তাব সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরে মতবিনিময়ও করেছে ইসি।
কমিশনের নীতিমালার বিষয়টি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয় বলে মত দেন সাংবাদিকরা।
৮ মে, মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সাংবাদিকদের সঙ্গে কমিশনের মতবিনিময় সভা হয়। ‘বিভিন্ন নির্বাচনে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহ, প্রচার ও প্রতিবেদন প্রকাশ এবং ভোট গ্রহণের দিন ভোটকেন্দ্রে সংবাদ সংগ্রহ, প্রকাশ/প্রচারবিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণয়নসংক্রান্ত মতবিনিময় সভা’ নামের ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকরা। তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরাও ছিলেন।
এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সাংবাদিকরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। ওই সময় অধিকাংশ সাংবাদিকই নীতিমালা করার বিপক্ষে মত দেন।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া ভোটকক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। কমিশনের এমন প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে সভায় একাধিক সাংবাদিক বলেন, নির্বাচনের সময় প্রিসাইডিং অফিসাররা থাকেন ভোটকেন্দ্রের ভেতর। প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হলে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে হবে ভোটকেন্দ্রে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সাংবাদিকরা স্বাভাবিকভাবেই ভোটকেন্দ্রে প্রবেশও করতে পারবেন না, অনুমতিও নিতে পারবেন না। তা ছাড়া ভোটকেন্দ্রে জালিয়াতি হলে, প্রিসাইডিং অফিসার আক্রান্ত হলে বা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও সংবাদ প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকবে না।
বর্তমানে ভোটকেন্দ্রের অবস্থা গণমাধ্যমের কারণে মানুষ জানতে পারে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে ভোটকেন্দ্রের ভেতর কী হচ্ছে, সেসবের কোনো কিছুই সাধারণ মানুষ জানতে পারবে না বলেও মত দেন সাংবাদিকরা।
নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সংবাদকর্মী সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সবাই কম-বেশি অবগত যে, প্রিসাইডিং অফিসাররাই নির্বাচনে সরাসরি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে। প্রিসাইডিং অফিসারদের ব্যালট পেপারে সিল মারা, একজন প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে দেখে থাকব। যে কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের কাছ থেকে কেন আমরা অনুমতি নেব? নির্বাচন কমিশন কি এর মাধ্যমে নিজেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?
বিগত সময় আমরা দেখে থাকব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কর্মকর্তা এবং নির্বাচনের সঙ্গে জড়িতদের জন্যই আজকে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ভঙ্গুর অবস্থা। তারা যদি নিজেদের জায়গায় শক্ত থাকত, তাহলে এই অবস্থার তৈরি হতো না। যারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে আসছে, তারাই আজকে বলছে, সাংবাদিকদের একটা নীতিমালার আওতায় আনা হোক। কারণ আমরা তাদের অপরাধকে প্রকাশ করি। তাদের অপরাধ যেন না প্রকাশ করতে পারি, সে জন্য তারা এটা করছে।’
দুঃখ প্রকাশ করে এই সাংবাদিক বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সেই নীতিমালা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে আসছে।’
প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারবেন না, এর পক্ষেই মত দেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। এ সময় সাংবাদিকরা বারবার এর প্রতিবাদ করেন ও যুক্তি তুলে ধরেন। কিন্তু সচিব তার বক্তব্যেই অনড় থাকেন।
কমিশনের কাছে চ্যানেল ২৪-এর এক সাংবাদিক জানতে চান, নির্বাচনী কাজে সাংবাদিকরা বাধা দিয়েছে, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের কাছে আছে কি না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকে, তাহলে কেন সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে নীতিমালার আওতায় আনা হচ্ছে। তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী কাজে বাধা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের কথা বলতে পারেনি কমিশন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিতাদেশের বিষয়টি নির্বাচন কমিশন জানতে পারে গণমাধ্যমের সাহায্যে। কমিশনের আইনজীবী বা কোনো নির্বাচন কর্মকর্তা স্থগিতাদেশের বিষয়টি জানাতে পারেননি। তাহলে নির্বাচনী কাজে সহযোগিতা করা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের কারণ কী, এমনটা কমিশনের কাছে জানতে চান আরেক সাংবাদিক। এরও কোনো উত্তর দেয়নি কমিশন।
নীতিমালায় যেসব বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেসব প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা। কিন্তু কমিশন অধিকাংশ প্রশ্নেরই কোনো ধরনের সদুত্তর দিতে পারেনি।
যা প্রস্তাব করল ইসি
নীতিমালার খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘গণমাধ্যমে নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহ ও ফলাফল প্রচারে সুশৃঙ্খল ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন। উল্লিখিত নির্দেশনাসহ আরও নীতিমালা, নির্দেশনা, প্রয়োজন হলে তা-ও নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একটি কার্যকরী সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে সকলের সুচিন্তিত মতামত ও প্রস্তাব প্রয়োজন।’
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবগুলো হলো প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া ভোটকক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। তবে অনুমতি সাপেক্ষে স্বল্প সময়ের জন্য ভোটকক্ষের ভেতর প্রবেশ করা যাবে এবং ভোট গ্রহণ কার্যক্রমের ছবি ভিডিও করা যাবে। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না গণমাধ্যমকর্মীরা। কোনো প্রকার নির্বাচনী উপকরণ স্পর্শ বা অপসারণ করতে পারবেন না তারা। নির্বাচনে প্রার্থী বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোনো ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সাংবাদিকদের বিরত থাকতে হবে।
ইসির প্রস্তাবে আরও বলা হয়, গণমাধ্যমকর্মীরা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার জন্য সংবিধান, নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান মেনে চলবেন। কোনোক্রমেই ভোটকেন্দ্রের গোপনকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না এবং এর ভেতরে কোনো ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে পারবেন না তারা। ভোটকেন্দ্রের ভেতর নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী, পোলিং এজেন্ট বা দায়িত্বরত/কর্মরত কারো সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না। ভোটকক্ষের ভেতর থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। ভোট গণনার কার্যক্রমের ছবি সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। একই সাথে একাধিক সাংবাদিক একই কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ইসির বক্তব্য
সাংবাদিকদের দেওয়া মতামতকে সম্মান দিয়েই নীতিমালা করার কথা জানান ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তবে নির্বাচন কমিশনের খসড়া প্রস্তাবের পক্ষেই মত দেন সচিব। প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার সময় সাংবাদিকরা বারবার প্রতিবাদ করলেও নিজের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি হেলালুদ্দীন।
নির্বাচন কমিশন বলছে, শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করার জন্যই তারা এই নীতিমালা করছে।
সভায় উপস্থিত কমিশনের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা আজকে বসেছি, আপনাদের অভিজ্ঞতা আর আমাদের অভিজ্ঞতা সমন্বয় করে কীভাবে সম্পূরক ভূমিকা পালন করা যায়। আপনারা আমাদের কীভাবে সহযোগিতা করতে পারেন, আমরা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি। সর্বোপরি আমাদের নীতিমালার উদ্দেশ্য হলো শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করা।’
সূত্র: প্রিয় ডটকম